বেকারি প্রশিক্ষণ নিবেন কেন?
এক কাপ চায়ের সাথে মন ভেজানো বেকারি বিস্কুট সবার পছন্দ। অতিথি আপ্যায়নেও আমরা প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের বেকারি আইটেম ব্যবহার করে থাকি। নাস্তার টেবিল কিংবা বিকালের আড্ডা বিস্কুটের প্যাকেট এর বিকল্প নাই, এছাড়া বিভিন্ন জন্মদিন, মজাদার অনুষ্ঠান বেকারি আইটেম ছাড়া ভাবাই যায় না। এ সকল পণ্য তালিকা সাথে এখন ফাস্টফুড, মিষ্টি সহ আরো অনেক মজাদার খাবার যুক্ত হয়েছে এবং দিন দিন এগুলোর চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। যেহেতু এটি উৎপাদন খরচ কম, সহজেই শুরু করা যায় তাই বেকারি ব্যবসা এখন অনেকের কাছে জনপ্রিয়। এ ব্যবসা শুরু করার জন্য আগে খাদ্য জ্ঞান থাকতে হবে। কারণ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে না পারলে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী যেকোনো ধরনের শাস্তি হতে পারে।
বেকারি ব্যবসার সুবিধা
বেকারি থেকে বন পাউরুটি কেক বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট সহজলভ্য হওয়ায় যে কোন মানুষ সহজে কিনে খেতে পারে। এবং এ ধরনের পণ্যের দাম ক্রেতার নাগালে থাকায় প্রচুর পরিমাণ বিক্রি হয়। ব্যবসা শুরু করতে ও খুব বেশি পুঁজির প্রয়োজন হয়না। প্রাথমিকভাবে লাখখানেক টাকা দিয়ে শুরু করা যায় আর.৪/৫ লাখ টাকা হলে তো বেকারি খুলে সহজে এ সকল পণ্য উৎপাদন করা যায়। এর সুবিধা হচ্ছে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করা যায় এবং প্রতিদিনের পণ্য প্রতিদিন এই বিক্রি হয়ে যায়। তবে এ ব্যবসা শুরু করতে হলে খাদ্য সম্পর্কে এবং খাদ্যের মান, মান সম্মত খাদ্য, পুষ্টি গুণ, বিএসটিআই ও বাংলাদেশে প্রচলিত খাদ্য আইন সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। আসুন জেনে নিই বিস্তারিত।
খাদ্য (Food)
মানুষের দেহের চালিকা শক্তির জন্য চাহিদা মিটাতে মুখে যে সকল দ্রব্য গ্রহণ বা পান করে তাকে, খাদ্য বলে। দেহের এই শক্তি ভাত, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, সবজি, ফল, তৈল ও চিনি এসব খাদ্য থেকে পাওয়া যায়। মূল কথা যেসব খাদ্য দ্রব্য গ্রহণ করলে দেহের গঠন, বৃদ্ধি সাধন, কর্মশক্তি উৎপাদন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং দেহ সুস্থ থাকে তাকেই খাদ্য বলে।
মান সম্মত খাদ্য (Quality Food)
পণ্যের স্পেসিফিকেশন বা মান অনুযায়ী যথাযথ কাঁচামাল ব্যবহার করে সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ভোক্তার চাহিদামত বা নির্দিষ্ট ডিজাইনের যে খাদ্যপণ্য তৈরি ও সংরক্ষণ করা হয়, তাকে মানসম্মত খাদ্য বলে। খাদ্যে মাত্রা অতিরিক্ত প্রিজারভেটিভ, নিম্নমানের কাঁচামাল এবং ফুডগ্রেড নয় এমন রং ব্যবহার নিষিদ্ধ। ইহা পণ্যের গুণগতমান ও বিশুদ্ধতা নষ্ট করে ফলে পণ্য নির্ধারিতমানের সমপর্যায়ে থাকে না। অসুস্থ্য প্রানী থেকে প্রাপ্ত খাদ্য ও বিষাক্ত দ্রব্যযুক্ত খাদ্যকে মানসম্মত বলা যাবে না।
পুষ্টি (Nutrition)
যে প্রকারের খাদ্য বস্তু আহরণ করার পর পরিপক্ক ও পরিশোধিত হয় পরে বিভিন্ন কোষে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেহের বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ, কর্মশক্তি উৎপাদন ও রোগ প্রতিরোধ বাড়াতে সাহায্য করে। ইহা দেহের অভ্যন্তরে একটি জৈবিক শক্তি প্রক্রিয়া খাদ্যের সাথে পুষ্টির সম্পর্ক নিবিড়। খাদ্য তৈরি ও গ্রহণের পদ্ধতি জানা থাকলে কম খরচেও পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
খাদ্যে ভেজাল (Adulterated in food)
ভেজাল খাদ্য বলতে বিশুদ্ধ খাদ্যের সাথে এমন কোন দ্রব্য (খাদ্য বা পানীয় হিসেবে) মিশ্রণ ঘটানোকে বুঝায়, যাতে অনুরুপ খাদ্য বা পানীয় স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়। ঐ ক্ষতিকর দ্রব্যকে খাদ্যের ভেজাল বলে। ভেজালের কারণে খাদ্যের গুণাগুণ নষ্ট হয় ও ভোক্তা সাধারণ বিক্রেতার কাছ থেকে সঠিক মানের খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়।
যদি কোন খাদ্য অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি, পেকেজিং করা হয় তবে সেটা দূষিত হয়ে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আংশিক বা সম্পূর্ণরুপে পচাঁ, বাসি, দুগন্ধযুক্ত, পোকাযুক্ত খাদ্য স্বাস্থ্যহানিকর। খাদ্যে ভেজালকারীদের জন্য এবং নিম্নমানের খাদ্যপণ্য উৎপাদন বা সরবরাহকারীদের জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান।
নিরাপদ খাদ্য (Safe food)
ক্ষুধার সময় খাদ্য ও পণ্য গ্রহন করবার পর যদি আমাদের শারিরীক সুস্থ্যতা অটুট থাকে, পেটের বা শারিরীক অসুস্থ্যতা সৃষ্টি না হয় তবে ঐ সকল খাদ্যকে নিরাপদ খাদ্য বলে। স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশে ক্ষতিকর দ্রব্য সম্পূর্ন পরিত্যাগ করে জীবানুমুক্তভাবে নিরাপদ খাদ্য তৈরি করা সম্ভব। যদি কোন খাদ্য অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি প্যাকেজিং করা হয় তবে সেটা দুষিত হয়ে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আংশিক বা সম্পূর্ন ভাবে পচাঁ-বাসি, দুরগন্ধযুক্ত, পোকাযুক্ত খাদ্য স্বাস্থ্যহানিকর।
মানসম্মত ও নিরাপদ (Quality and safe food) খাদ্য তৈরী আজ অতি জরুরী বিশ্বব্যাপী জনগনের খাদ্য সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসা ক্ষেত্রে সফলতা আনতে সকল উৎপাদনকারীকে মানসম্মত ও নিরাপদ খাদ্য তৈরীতে সোচ্চার হতে হবে। নইলে ভোক্তাসাধারন উৎপাদনকারীর পণ্য গ্রহন হতে বিরত থেকেই বড় শাস্তি দিতে পারে।
বাংলাদেশে খাদ্য সংক্রান্ত আইন
খাদ্যে ভেজালকারী, নিম্নমানের পণ্য উৎপাদন বা সরবরাহ এবং ওজনে কারচুপির জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান।
বাংলাদেশ বিশুদ্ব খাদ্য রুলস-১৯৬৭
বিশেষ ক্ষমতা আইন- ১৯৭৪, (১৯৭৮ সালে সংশোধিত)
খাদ্য শস্য সরবরাহ অধ্যাদেশ -১৯৫৬
তেজক্রিয়তা নিয়ন্ত্রন আইন-১৯৮৭
আয়োডিন ঘাটতি আইন-১৯৮৯
অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি আইন-১৯৯০
মৎস্য ও মৎস্য দ্রব্য আইন-১৯৯৭
বাংলাদেশ বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ -১৯৫৯ এবং (সংশোধন) এ্যাক্ট ২০০৫
বাংলাদেশ ষ্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেষ্টিং ইন্সটিটিউশন অধ্যাদেশ -১৯৮৫ এবং (সংশোধন) এ্যাক্ট ,২০০৩
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন অধ্যাদেশ, ১৯৯৪
দি ষ্ট্যান্ডার্ডস অব ওয়েটস এন্ড মেজার্স এ্যাক্ট, ১৯৮২ এবং (সংশোধন) এ্যাক্ট, ২০০১
পণ্য সামগ্রী মোড়কজাতকরণ বিধিমালা -২০০৭
মোবাইল কোর্ট আইন – ২০০৯
বেকারি ট্রেনিং
এই প্রশিক্ষণ দু’ধরনের
- ব্যবসা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ
- বেকারি পণ্য সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ
বেকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ঢাকা
ঢাকাতে যে সকল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বেকারি প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে তাদের তালিকা দেয়া হলো । এ সকল প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে, নিয়মিত তাদের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে এ বিষয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। তাই আপনার আগ্রহ থাকলে আপনি তাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে আপডেট তথ্য পেতে পারেন-
- ঢাকাতে যে সকল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বেকারি প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে তার মধ্যে লেসাফ্রে অন্যতম।লেসাফ্রে বেনগ্ল্যাডে কারিগর এবং শিল্প বেকারিদের কাছে উদ্ভাবনী এবং কার্যকরী রুটি তৈরির সমাধান। এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আপনি বেকারি পণ্য উৎপাদন করতে পারবেন।
- এসএমই ফাওউন্ডেশন
- বাংলাদেশ হোটেল ম্যানেজমেন্ট এন্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট
- Bakery and Pastry – PFDA – Vocational Training Center
- Ucep-bangladesh 6 মাস মেয়াদী বেকারি প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে
- কারু শিল্প নারী উন্নয়ন সংগঠন
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র
প্রথমে ভাড়া করা কোন দোকান নিয়ে ব্যবসা শুরু করা যেতে। পারে প্রাথমিকভাবে ৩/৪ জন কর্মচারী ও ছোটখাটো ২/১ টা মেশিন নিয়ে শুরু করা যায়।ডেলিভারি দেওয়ার জন্য ২/৩ টি ভ্যান রাখা যেতে পারে। ব্যবসার অবস্থা ভালো হলে পুঁজি বাড়ানো যেতে পারে।
আপনার একটি কারখানাতেই বিস্কুট, কেক, বিভিন্ন ধরনের রুটিসহ সব ধরনের বেকারি পণ্য বানাতে পারেন। প্রাথমিকভাবে বিস্কুট তৈরিতে লাগবে ওভেন, বিশেষ ধরনের টেবিল, ছাঁচ, পাতা মেশিন (যেখানে বিস্কুট কেটে রাখা হয়) এবং মিকশ্চার মেশিন। কেক বানাতে লাগবে ছাঁচ, বিশেষ ধরনের কাগজ, ছুরি। পাউরুটি বানাতে কিনতে হবে এক বা দুই পাউন্ডের ছাঁচ ও ব্রাশ। এসব যন্ত্রপাতি রাজধানীর বংশাল, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়। কিছু যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয় ভারত ও চীন থেকে। এ ছাড়াও লাগবে প্যাকেটজাত করা মেশিন, আটা, ময়দা, চিনি, তেলসহ প্রয়োজনীয় পণ্য।
বেকারি মেশিনের দাম
প্রতিষ্ঠানভেদে এবং চাহিদা পেতে মেশিনের দাম বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। বিশেষ করে অটোমেটিক মেশিনের দাম একটু বেশি হয়ে থাকে। এসকল মেশিন সাধারণত চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা হয়। বাংলাদেশে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এসকল মেশিন বিক্রি করে থাকে। এসকল মেশিনের দাম সাধারণত দুই লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। তবে মেশিন কেনার আগে পণ্য সম্পর্কে, বিশেষ করে বেকারি পণ্য উৎপাদন সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। সাথে সাথে ব্যবসা করার জন্য ব্যবসা সংক্রান্ত জ্ঞান, বিশেষ করে বাজারজাতকরণ বা মার্কেটিং সম্পর্কে ভালো ধারণা না নিয়ে ব্যবসা শুরু করা ঠিক হবে না। ব্যবসা শুরু করার জন্য শুধু তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ না নিয়ে হাতে কলমে কোন কারখানায় প্রশিক্ষণের সবচেয়ে ভালো হয়।
কিভাবে বেকারি ব্যবসা শুরু করবেন?
বর্তমান সময়ে বেকারি ব্যবসা বেশি লাভজনক এবং যে কেউ এটি শুরু করতে পারেন। তবে ব্যবসা শুরু করার আগে মার্কেট সম্পর্কে গবেষণা করার প্রয়োজন। আপনার আশেপাশে যেখানে আপনি ব্যবসা শুরু করতে চান সেখানে দেখতে পাবে আর কোন বেকারি প্রতিষ্ঠান আছে কিনা, বর্তমানে সেখানে যারা ব্যবসা করছে তার থেকে ভালো পণ্য সরবরাহ করতে হবে বা সার্ভিস আরো ভালো দিতে হবে তাহলে আপনি ব্যবসায় টিকে থাকতে পারবে।
ব্যবসা শুরুর জন্য আপনার একটি কারখানা এবং একটি শো রুম লাগবে। ছোট পরিসরে শুরু করতে পারেন আস্তে আস্তে আপনার ব্যবসা বাড়তে থাকলে আপনি বড় কোন জায়গায় কারখানা স্থাপন করতে পারবেন এবং কারখানা শুরু করতে হলে আপনাকে মেশিন স্থাপন করতে হবে। আপনি যে ধরনের মেশিন ক্রয় করতে চান সেটি ওয়েবসাইট বা ইন্টারনেটে সার্চ দিলে খুঁজে পাব… সে অনুযায়ী আপনাকে পুঁজি সংগ্রহ করতে হবে বা ব্যাংক লোন নিতে হব।।
বেকারি মেশিন কেনা হয়ে গেলে বেকারি আইটেম তৈরি করার জন্য আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ দিতে হবে। পূর্বে তারা বেকারি আইটেম তৈরি করার কারখানায় কাজ করেছে কিনা সেটা ভালভাবে যাচাই করে নিবেন।