সফল উদ্যোক্তার জীবনী যারা ধাপে ধাপে শূন্য থেকে শীর্ষে পৌঁছেছেন
(১) শেখ আকিজউদ্দিনঃ ফেরিওয়ালা থেকে শিল্পপতি
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প পরিবারেরমালিক হচ্ছেন শেখ আকিজ উদ্দিন। যিনি তার জীবন শুরু করেছিলেন একজন সামান্য রাস্তার ফেরিওয়ালা হিসেবে। তার ভাষ্যমতে ১৯৪২ সালে তিনি তার বাবার কাছ থেকে মাত্র ১৬ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন, গন্তব্য হচ্ছে কলকাতা। তিনি কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে গিয়ে আশ্রয় নেন । সারাদিন কাজের সন্ধান করতেন আর রাত হলে স্টেশনে কাগজ বিছিয়ে শুয়ে পড়তেন। তার সারাদিনের খাবার ছিল ছয় পয়সার ছাতু অবশ্য এর বেশি খরচ করার মত পয়সাও তার হাতে ছিল না।
কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন কারণ টাকা দ্রুত ফুরিয়ে আসছে কিন্তু উপযুক্ত কাজ এখনো খুঁজে পাননি এর মধ্যে রেলস্টেশনের কাছে স্থানীয় একজন হোটেল মালিকের সাথে তার পরিচয় হয়, ভদ্রলোক তাকে তার হোটেলের এক পাশে আশ্রয় দেন। তিনি চাকরির আশা ছেড়ে ব্যবসার চিন্তা শুরু করেন কিন্তু তাঁর হাতে ব্যবসা শুরু করার মতো পর্যাপ্ত পুঁজিও নাই। অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি কমলালেবু বিক্রির ব্যবসা শুরু করলেন। অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ পাইকারি দরে কমলা লেবু কিনে হাওড়া ব্রিজের আশেপাশে ফেরি করে বিক্রি করেন অবশ্য এজন্য পুলিশকে দুই টাকা ঘুষ দিতে হতো।
এর মধ্যে তিনি আরো একটি ব্যবসার সন্ধান পান সেটি হচ্ছে ভ্রাম্যমান মুদির দোকান এ ব্যবসার জন্য তাকে হিন্দি শিখতে হয় এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি হিন্দি ভাষা রপ্ত করে ফেলেন ফলে তার ব্যবসা জমে উঠল কিন্তু ঘটলো আরেক বিপদ হঠাৎ একদিন পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেল। তিন দিনের জেল ও জরিমানা হলো ।
জেল থেকে ফিরে এলেন বাড়িতে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার বাবা-মা দুজনেই মারা গেলেন তখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর ।তিনি ঠিক করলেন এবারে যাই করবেন নিজ এলাকায় করবেন কিন্তু কি করব ভেবে পাচ্ছিলেন না। সে সময় বিখ্যাত বিধুভূষণ এর ছেলে সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। সেই সুবাদে তার বিক্রি ধারণাটি মাথায় আসে। ১৯৫২ সালে প্রথম তিনি বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। তিনি ছাড়াও আরো দুইজন কর্মী নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে বেশ লাভের সন্ধান পান । তিনি বেজেরডাঙ্গা এলাকায় রেলস্টেশনের পাশে একটি মুদি দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। তার ভাষ্যমতে .১৯৫৪দিকে তার মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০০০০ টাকা হঠাৎ এক রাতে আগুন লেগে পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সারা জীবনের সঞ্চয়। তিনি আবার পথের ফকির হয়ে যান কিন্তু তিনি মনোবল হারাননি বিশ্বাস নিয়ে আবার শুরু করেন।
পরিচিত আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় তিনি আবার নতুন দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। কিছুদিনের মধ্যেই আবার লাখখানেক টাকার মালিক হয়ে যান । এরপর শুরু করেন ধান-পাট চাল-ডাল ইত্যাদির, ব্যবসার মূলধন ছিল তার বিশ্বস্ততায় নির্দ্বিধায় তাকে বিশ্বাস করত। সত্তর দশকের দিকে তিনি যশোরের সীমান্তবর্তী নাভারন বাজারে চলে আসেন, এ সময় স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বিশ্বাস তাকে সহযোগিতা করেন এবং তিনি বিড়ির ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। গড়ে তোলেন আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টর ।এরপর একে একে প্রতিষ্ঠিত হয় আকিজ তামাক ফ্যাক্টরি, আকিজ নেভিগেশ্ আকিজ জুট মিল, আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টর্ আকিজ সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ইত্যাদি। পাশাপাশি কিছু সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তোলেন আর বর্তমানে প্রায়,৪০ হাজার কর্মী তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন।
তিনি ছোটবেলায় দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অসহায় অবস্থা খুব কাছ থেকে দেখেছেন । তাই তিনি সবসময়ই এলাকার সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেন। সত্যি কথা বলতে তার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিল না কিন্তু অক্লান্ত পরিশ্রম, সততা আজকের অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।
(২) আব্দুল খালেক পাঠানঃ ট্রাক ড্রাইভার থেকে শিল্পপতি
বাংলাদেশের অন্যতম সেরা কেয়া কসমেটিকস এর মালিক আব্দুল খালেক পাঠান। জীবন শুরু করেছিলেন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চকলেট আর বিস্কুট বিক্রির মধ্য দিয়ে। তারপর ট্রাক ড্রাইভার।
তিনি যখন স্কুলে পড়েন তখন টিফিনের জমানো টাকায় তিনি চকলেট বিস্কুট এগুলো কিনতেন। তারপর রাস্তার পাশে দোকান সাজিয়ে বসতেন এবং বিক্রি করতে। তার কিছু লাভ হতো এবং সেই লাভের লোভে তিনি পড়ে গেলেন ।বন্ধুর সঙ্গে শুরু করলেন মুরগির ব্যবসা। স্থানীয় হাট থেকে মুরগি কিনে নিয়ে দূরের বাজারে বিক্রি করত। যৌথ কারবার থেকে লাভের টাকা খরচ করতেন না ফলে মূলধন বাড়তে লাগলো। মুরগির ব্যবসার ব্যাপারটা তার পরিবারের কেউই পছন্দ করতেন না ।তাই মুরগি কিনে তিনি রাখতেন তার বন্ধুর বাসায় । একদিন তার বন্ধু বলল মুরগিগুলো শিয়ালের নিয়ে গেছে। মুরগির কিছু পাখনা আর মায়া কান্না দিয়ে তার বন্ধু তাকে ভোলানোর চেষ্টা করল কিন্তু তার বুঝতে বাকি রইল না । সে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ল। তিনি ভাবলেন আমি বুঝি আর ব্যবসায়ী হতে পারবোনা।
এর কিছুদিন পরে তিনি তার নানা বাড়িতে গেলেন এবং কিছু টাকা জোগাড় করলেন, নতুন উদ্যমে আবার শুরু করলেন ব্যবসা এবার আর কোন পার্টনার নয় একাই ব্যবসা শুরু করলেন।
পরবর্তীতে তিনি ১৯৭৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন এরপর এই বিয়ে। তার স্ত্রী তার জমানো ৬০০ টাকা তার হাতে তুলে দিলেন আর এই টাকায় আমাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখলেন। তিনি শুরু করলেন লাকড়ি কিনে বিক্রির ব্যবসা। এরপর তার স্ত্রী তার কিছু গয়না গাটি ও তার হাতে তুলে দিল সেটি বিক্রি করে ফেলেন পেলেন ৫০০০ টাকা। একটা পুকুর লিজ নিয়ে রুই মাছের পোনা ছাড়লেন কিন্তু মাছ বড় হতে সময় লাগবে কমপক্ষে তিন বছর। তিনি ধৈর্য ধরে থাকতে পারলেন না সুতরাং এক বছরের মাথায় সব বিক্রি করে দিল। আবার শুরু করলেন লাকড়ির ব্যবসা এরপর তিনি একটি চাকরি নিলেন বেতন ৬০০ টাকা কিন্তু বেশিদিন সেখানে তিনি কাজ করতে পারলেন না ।মাথায় তার কেবল ব্যবসার পোকা, অনেক টাকার স্বপ্ন।
চাকরি ছেড়ে তিনি প্রগতি থেকে একটা ট্রাক কিনলেন ৪০ হাজার টাকা অগ্রিম পরিশোধ করে। ড্রাইভার রাখলেন তাঁর সঙ্গে থেকে ট্রাক চালানো শিখে ফেলবেন ১৫ দিনেই, মোটামুটি ট্রাক চালানো শেখা হয়ে গেলে এবার পথে নামার পালা। ড্রাইভার দিনে ডিউটি করে আর রাতে তিনি নিজেই ট্রাক চালান। এভাবে ছয় মাসছয় মাসেই তিনি একটি মোটা পুঁজি বানিয়ে ফেললেন এবং সেটি রাখতেন পূবালী ব্যাংকে।
একদিন ব্যাংকের অফিসার বললেন ইটের ভাটা বানান প্রয়োজনে আমরা ঋণ দেব। তিনি জমি কিনে ফেললেন, এবার ব্যাংক বেঁকে বসল ঋণ দিবেন না । তিনি পড়লেন মহা বিপদে । এরপর তার শ্বশুর তাকে সহযোগিতা করলেন। দুই লাখ টাকার ঋণ দিলেন, পরের বছর সোনালী ব্যাংক থেকে তিনি পেলেন তিন লাখ টাকা। এরপর ইটের ভাটা পাঁচটা হলো, এখন সেখানে বছরে প্রায় ২ কোটি টাকার ইট তৈরি হয়।
এরপর তিনি নিটিং ব্যবসায়ের পরিকল্পনা করলেন কিন্তু ব্যাংক ঋণ দেবে না । এজন্য একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বললেন আপনি মাত্র মেট্রিক পাস, ইটের ব্যবসা করছেন তাই করেন । নিটিং ব্যবসা ১০০ ভাগ রপ্তানি ব্যবসা, বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে হব্ এটা আপনি পারবেন না। তিনি বোঝাতে লাগলেন যে বিদেশ থেকে যে ক্রেতা আসবে সে মালের কোয়ালিটি দেখবে, আমি ইংরেজি জানি কিনা সেটা দেখবে না আর তাছাড়া ইংরেজি জানা লোক তো আমার থাকবেই কিন্তু বরফ গলল না।
তিনি পরবর্তীতে ভারত থেকে আঠারোটা নিটিং মেশিন কিনে নিয়ে আসলেন এবং কাজ পুরোদমে শুরু করলেন। এক পর্যায়ে ব্যাংকের লোকজন বুঝলো যে ইংরেজি না জেনেও এ লাইনে কাজ করা যায়। সফল হওয়া যা… এরপর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সদয় হলেন, সবকিছু দেখে তাকে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা ঋণ দিলেন। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, তার ইন্ডাস্টি থেকে প্রতিবছর এখন রপ্তানি হয় ৪০ কোটি টাকার কাপড়। সেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় তিন হাজার লোকের।এরপর তিনি কসমেটিকস তৈরিতে শুরু করলেন কেয়া নারিকেল তেল দিয়ে, তারপর পাউডার।
তিনি মনে করেন সততা ও পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই , সফলতা আসবেই। সবসময় মনে রাখতে হবে কখনো অন্যকে ঠকিয়ে বড় হওয়া যায় না। তিনি মনে করিয়ে দেন তার সেই মুরগি ব্যবসার বন্ধু কিন্তু এখনো কারখানার কর্মচারী রয়ে গেছেন।