আত্নকর্মসংস্থান ও ব্যবসায় উদ্যোগ
কিশোর যখন তরুণ হয়, তরুণ যখন যুবক হয্, তার চোখে মুখে স্বপ্ন সে বড় হবে। বড় মানুষ হয়ে সমাজ এবং দেশের সেবা করবে। এই উদ্দেশ্যে এবং নিজের জীবনের বোঝা লাঘবের জন্য বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করে। কিন্তু কে বা বলবে জীবনের বোঝা লাভের জন্য যে ডিগ্রি, সেই ডিগ্রী একদিন বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
অধিকাংশ এমন কোন বেকার নাই যার এমবিএ ডিগ্রি নাই বরং এসএসসি বা এইচএসসি পাস করা কম শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের তুলনায় উচ্চশিক্ষিত এমবিএ ডিগ্রী ধারী হচ্ছে বেশি সংখ্যক বেকার। আপনি যদি আজকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেতনের কোন চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেন, আর যোগ্যতা লিখে দেন ন্যূনতম মাস্টার্স পাস বা এমবিএ ডিগ্রী তাহলে কমপক্ষে আপনি ১০ হাজার দরখাস্ত পাবেন কিন্তু আপনি যদি আজকে একটু ড্রাইভার নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেন এবং বেতন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা দেন তাহলে আপনি এত সংখ্যক দরখাস্ত পাবেন না।
কিছুদিন আগে বিডি জবস একটি সার্কুলার দেখলাম যেখানে একজন চাকরি প্রার্থীর যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে ইঞ্জিনিয়ার বেতন লেখা হয়েছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পাশাপাশি একজন ড্রাইভার নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে যেখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে অষ্টম শ্রেণি পাস বেতন অফার করা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা।
একটি চাকরির জন্য মানুষ কত না সার্টিফিকেট অর্জন করে আজকে এমবি এর গুরুত্ব বেশি সবাই হুমড়ি খেয়ে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করল কালকে যদি অন্য কোনো ডিগ্রী গুরুত্ব পায় তাহলে সবাই হুমড়ি খেয়ে সে ডিগ্রী অর্জন করবে এবং দিনশেষে কারিগরি সার্টিফিকেট তার জীবনের বোঝাতে নতুন আরেক বোঝা যোগ হয় করে।
অথচ বাস্তবতা হচ্ছে আপনি যদি কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন তাহলে আপনার কাজ পেতে কোন সার্টিফিকেট লাগবে না। সেদিন এক আইসিটি শিক্ষকের সাথে কথা হল যিনি বাংলাদেশের বিখ্যাত একটি ইনস্টিটিউটের আইসিটি শিক্ষক অথচ তার আইসিটি ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না এমনকি আইসিটি বিষয়ে বলার মত তেমন কোন সার্টিফিকেট নেই।
যারা চাকরি প্রত্যাশী তাদেরকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় আপনার অনেকগুলো সার্টিফিকেট আছে ঠিক কিন্তু আপনি কি পারেন? এটা যদি প্রশ্ন করা হয় অধিকাংশ বলবে, যে আমার অমুক অমুক সার্টিফিকেট আছে কিন্তু তাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে আপনি কি পারেন তার সঠিক উত্তর অনেকেই দিতে পারবে না ।
আসলে চাকরির বাজারে প্রাথমিক বাছাইয়ের পর প্রথম যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে কমিউনিকেশন স্কিল, ইন্টার পার্সোনাল স্কিল, আপনার কথা, আপনার পোশাক। আপনার স্মার্টনেস দেখে একজন মানুষ কতটুকু ইমপ্রেস হয় সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর চাকুরী ক্ষেত্রে সফল হতে হলে আপনাকে জানতে হবে কিভাবে টিমে কাজ করতে হয়? কিভাবে টিমকে পরিচালনা করতে হয়, সাথে সাথে কমিউনিকেশন স্কিল বলা এবং লেখা দুই ক্ষেত্রে।
আপনি কি এ+ পেয়ে ঝাড়ুদার হতে চান?
কিছু দিন আগে ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যে ১১৯ টি ঝাড়ুদার পদের জন্যে ১৯ হাজার এমবিএ এবং গ্রাজুয়েট ডিগ্রিধারী আবেদন করেছে যেখানে পোস্টটির জন্যে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতাই চাওয়া হয় নি। মাত্র ১৭ হাজার রুপি বেতনের একটি ঝাড়ুদারের চাকরির জন্যে আবেদন করছেন এতজন এমবিএ ডিগ্রিধারী।
এর পেছনে দায়ী আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যাতে চাকরি পাওয়ার জন্য আমাদেরকে প্রস্তুত করা হয় সর্বান্তকরণে। আমাদের শিক্ষায় দক্ষতা সৃষ্টি বা অর্থ উপার্জনের প্রক্রিয়া কিংবা নৈতিক শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই।
অথচ ইংরেজ প্রবর্তিত এ শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার আগে আমাদের এ জনপদে শিক্ষার মূল ভিত্তিই ছিল ধর্ম, নৈতিকতা- সেটা টোলভিত্তিক হোক বা মাদ্রাসাভিত্তিক হোক। কোরান অথবা পুরান এই ছিল তার ভিত্তি।
শিক্ষা, সমাজ আর সংস্কৃতির এই নৈতিক ভিত্তি যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ আমাদেরকে দাস বানানো সম্ভব নয়, এই উপলব্ধিতে খুব দ্রুতই পৌঁছে গিয়েছিল আমাদেরকে শাসন করতে আসা উপনিবেশবাদীরা। ফলে নৈতিক ও ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাকে বদলে তারা প্রতিষ্ঠা করল ডারউইনের মতবাদপুষ্ট বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থা যার মূল দর্শন হলো- সারভাইভল অফ দ্যা ফিটেস্ট- অর্থাৎ জোর যার মুল্লুক তার নীতি। যে শিক্ষায় দয়া-মায়া নৈতিকতার চেয়েও গুরুত্ব পেলো স্বার্থপরতা, জৈবিকতা, টাকা কামাই করার মানসিকতা।
চাকরিই কি একমাত্র নিরাপত্তা?
উদ্যোক্তা বা স্বাধীন পেশা নয় (একসময় আমাদের পূর্বপুরুষরা যা ছিলেন), একটা চাকরি পেলেই জীবনের সব নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে যাবে, এরকম ভীরু, অকর্মন্য, চাকর মানসিকতায় ভারাক্রান্ত হলাম আমরা এ শিক্ষার কারণেই। এ থেকেই বোঝা যায় কতটা মেরুদণ্ডহীন মানসিকতায় রূপান্তরিত হয়েছে আজকের তরুণসমাজ!
যারা চাকরি করছেন, তাদের অবস্থা কি?
মানবাধিকার সংগঠন অক্সফাম একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। আমেরিকার চিকেন ফ্যাক্টরিগুলোতে কর্মীরা কি অমানবিক অবস্থায় কাজ করছে তার এক করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে এতে। বলা হয়, প্রতি মিনিটে ১৪০ টা মুরগি প্রসেস করতে গিয়ে যে অমানুষিক দ্রুততায় তাদের কাজ করতে হয় এবং প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্যে অব্যহতি পাওয়া তো পরের কথা, সেটার কথা সুপারভাইজারকে বলাও তাদের পক্ষে এত কঠিন যে, বাধ্য হয়ে কর্মীরা কাজে আসেন ডায়াপার পরে। যাতে প্রস্রাব এলে কাজের জায়গায় দাঁড়িয়েই তা করতে পারেন। কারণ একবার পোলট্রি প্ল্যান্ট চালু হলে দিনশেষে সব চিকেন প্রসেস না হওয়া পর্যন্ত প্ল্যান্ট বন্ধ হওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই।
ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থা আপনাকে দিয়ে তাঁর স্বার্থ হাসিল করবে। সভ্য মানুষগুলো তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আপনি নিজেকে বলি দিবেন চাকর হিসেবে। সে আপনাকে দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করাবে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে।
এখন, দক্ষতার সাথে অপরাধ করার নামই হলো সভ্যতা। খুব খারাপ কাজ করেও যদি আপনি তাকে ভালোভাবে আচ্ছাদিত করতে পারেন, তাহলেই আপনি অত্যন্ত সভ্য ও সজ্জন ব্যক্তি। আর যদি তা না করেন, তাহলেই আপনি অসভ্য, গাঁইয়া ও বদমাশ। এটাই সভ্যতার রহস্য।
চাকরির বিকল্প ব্যবসায় উদ্যোগ হতে পারে আপনার জন্য উত্তম উপার্জনের উত্তম পন্থা।