বহুল প্রতীক্ষিত বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫ এর শেষ হল, শুরু হল আলোচনা, সংযোগ আর সম্ভাবনার অনুরণন। সম্মেলন কক্ষে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ, উপস্থাপিত প্রতিটি স্লাইড, আর প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি সংযোগ – সবই জানান দিয়েছে এক নতুন বাংলাদেশের আগমনী বার্তা। এই সম্মেলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর সুদক্ষ নির্বাহী চেয়ারম্যান, জনাব আশিক চৌধুরী । তার বলিষ্ঠ ও তথ্যবহুল বক্তব্য শুধু উপস্থিত দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরই অনুপ্রাণিত করেনি, বরং বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাকে এক নতুন আঙ্গিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে।
সম্মেলন শেষে এখন প্রশ্ন উঠছে – কী ছিল সেই মূল বার্তা? জনাব আশিক চৌধুরী ঠিক কোন বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করলেন যা উদ্যোক্তা হিসেবে আপনার জন্য জানা জরুরি? আপনি যদি বাংলাদেশে বিনিয়োগ বা ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা ভেবে থাকেন, তবে এই সম্মেলনের নির্যাস, বিশেষ করে বিডা চেয়ারম্যানের বিশ্লেষণ, আপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তার কথায়, “এই বিনিয়োগ সম্মেলন শুধু পরিসংখ্যানের প্রদর্শনী ছিল না, এটি ছিল বাংলাদেশের সক্ষমতা, স্থিতিশীলতা এবং ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রতিফলন।”
আমরা বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫-এ জনাব আশিক চৌধুরীর তুলে ধরা বাংলাদেশের মূল সম্ভাবনাগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করব। তার বক্তব্যের আলোকে দেখব কেন বাংলাদেশ আপনার পরবর্তী লাভজনক গন্তব্য হতে পারে, কীভাবে আপনার পথচলাকে মসৃণ করবে এবং সম্মেলনের বাস্তব ফলাফল কী ইঙ্গিত দিচ্ছে। চলুন, সম্মেলনের মঞ্চ থেকে সরাসরি প্রাপ্ত তথ্য, উদাহরণ আর অনুপ্রেরণামূলক উক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের গভীরে প্রবেশ করি।
বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫: কেন এই সম্মেলন ছিল এক মাইলফলক?
বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫ নিছক কোনো বার্ষিক আয়োজন ছিল না, এটি ছিল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নের পথে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ। সম্মেলনটি সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর এর তাৎপর্য আরও স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে:
- আস্থা ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু: সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি, বহুজাতিক কোম্পানির সিইও এবং শত শত সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছে যে, বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ এখন এক আস্থার নাম। জনাব চৌধুরী যেমনটি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, “বিশ্ব আজ বাংলাদেশকে দেখছে সম্ভাবনার বাতিঘর হিসেবে, আর এই সম্মেলন সেই বাতিঘরের আলো আরও প্রখর করেছে।”
- সফল সংযোগ স্থাপন: সম্মেলনের বিভিন্ন সেশন, প্যানেল ডিসকাশন এবং বিশেষ করে নেটওয়ার্কিং ইভেন্টগুলোতে নীতিনির্ধারক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সরাসরি ও খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। অনেক সম্ভাব্য অংশীদারিত্বের ভিত্তি এখানেই রচিত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাস্তব উদাহরণ: সম্মেলনে উপস্থিত একাধিক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম স্থানীয় স্টার্টআপগুলোর সাথে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছে বলে জানা গেছে, যা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের ইঙ্গিত বহন করে।
- বাংলাদেশের ‘নতুন ব্র্যান্ডিং’: সম্মেলনটি সফলভাবে বাংলাদেশকে কেবল স্বল্প পারিশ্রমিকের উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে নয়, বরং প্রযুক্তি, উদ্ভাবন এবং টেকসই উন্নয়নের অগ্রযাত্রী হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন সেশনে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এর বৈচিত্র্যময় পণ্যের (যেমন: ফার্মাসিউটিক্যালস, আইটি সেবা, হালকা প্রকৌশল পণ্য) উপস্থাপনা দর্শকদের মুগ্ধ করেছে।
- নীতিগত স্বচ্ছতা ও প্রতিশ্রুতি: সম্মেলনের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারের মন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ শুনেছেন এবং নীতিগত সহায়তা অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। বিডা’র ওয়ান স্টপ সার্ভিস (OSS) এর কার্যকারিতা সরাসরি প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতার প্রমাণ দেওয়া হয়েছে।
এই সম্মেলন কার্যকরভাবে প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশ শুধু বিনিয়োগ আহ্বানই করছে না, বরং বিনিয়োগের সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
আশিক চৌধুরীর দূরদর্শী নেতৃত্ব: শুধু আশ্বাস নয়, কার্যকর সমাধান
বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫ এর সফল আয়োজনের নেপথ্যে এবং পুরো সময় জুড়ে বিনিয়োগকারীদের সার্বিক সহায়তায় বিডা’র ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। জনাব আশিক চৌধুরীর নেতৃত্বে বিডা এখন আরও বেশি বিনিয়োগকারী-কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, যা সম্মেলনের বিভিন্ন কার্যক্রমে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে:
- কার্যকর ওয়ান স্টপ সার্ভিস (OSS) প্রদর্শন: সম্মেলনের একটি বিশেষ স্টলে বিডা’র OSS পোর্টালের লাইভ ডেমোনেস্ট্রেশন দেখানো হয়। বিনিয়োগকারীরা সরাসরি দেখতে পান কীভাবে কোম্পানি নিবন্ধন থেকে শুরু করে বিভিন্ন লাইসেন্স ও পারমিট (বর্তমানে ৫০টির বেশি সেবা) অনলাইনে সহজে পাওয়া যায়। জনাব চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, “আমরা ওয়ান স্টপ সার্ভিসকে শুধু একটি অনলাইন ফর্ম পূরণের ব্যবস্থা হিসেবে দেখি না, আমরা এটিকে দেখি বিনিয়োগকারীর সময় ও অর্থের সাশ্রয়কারী একটি অত্যাবশ্যকীয় টুল হিসেবে। এই সম্মেলনে আমরা এর বাস্তব কার্যকারিতা তুলে ধরেছি।”
- বাস্তব উদাহরণ: সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী তাৎক্ষণিকভাবে OSS পোর্টাল ব্যবহার করে তার কোম্পানির নাম নিবন্ধনের প্রাথমিক ধাপ সম্পন্ন করার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন, যা অন্যদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করে।
- বিনিয়োগকারীদের জন্য নিবেদিত টিম: সম্মেলনের পুরো সময় জুড়ে বিডা’র একটি নিবেদিত টিম উপস্থিত ছিল, যারা সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে, প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করেছে।
- নীতি সহায়তার আশ্বাস: জনাব চৌধুরী সম্মেলনে একাধিকবার বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করেছেন যে, বিডা শুধু লাইসেন্স প্রদান করেই দায়িত্ব শেষ করবে না, বরং ব্যবসা পরিচালনার যেকোনো পর্যায়ে নীতিগত বা পদ্ধতিগত সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। তিনি বলেন, “আপনারা বিনিয়োগ করুন, প্রতিবন্ধকতা দূর করার দায়িত্ব আমাদের।”
সম্মেলনে বিডা’র এই সক্রিয় ও সহায়ক ভূমিকা বিনিয়োগকারীদের মনে গভীর আস্থা তৈরি করেছে, যা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ প্রবাহে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
কেন বাংলাদেশ বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দু:
বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫-এর বিভিন্ন সেশনে এবং তার মূল বক্তব্যে জনাব আশিক চৌধুরী অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের সেই শক্তিগুলোর কথা তুলে ধরেছেন, যা দেশটিকে আজকের আকর্ষণীয় অবস্থানে নিয়ে এসেছে। তার বক্তব্যের চুম্বক অংশগুলো দেখা যাক:
- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই প্রবৃদ্ধি: আস্থার অটল ভিত্তি
- তিনি তুলে ধরেন কীভাবে বৈশ্বিক নানা সংকটের মাঝেও বাংলাদেশ ৬ শতাংশের বেশি গড় প্রবৃদ্ধি (২০২২-২৩ অর্থ বছরে প্রায় ৬.০৩%) ধরে রেখেছে। তিনি বলেন, “এই স্থিতিশীলতা কোনো জাদু নয়, এটি আমাদের সরকারের বিচক্ষণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং জনগণের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আমরা আরও বড় স্বপ্ন দেখছি।”
- মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি (প্রায় ২,৭৬৫ ডলার) এবং এর ফলে সৃষ্ট শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ বাজারের চিত্র তিনি তুলে ধরেন, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রাথমিক ঝুঁকি কমায়।
- সরকারের বিনিয়োগ-বান্ধব নীতি: ব্যবসার মসৃণ পথ
- জনাব চৌধুরী সম্মেলনে বারবার উদার বিনিয়োগ নীতি, ১০০% বিদেশি মালিকানার সুযোগ এবং মুনাফা প্রত্যাবাসনের সহজীকরণের কথা উল্লেখ করেন।
- তিনি কর অবকাশ, হ্রাসকৃত কর হার এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য প্রদত্ত প্রণোদনাগুলোকে “বিনিয়োগের অনুঘটক” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তার কথায়, “আমরা শুধু বিনিয়োগ চাই না, আমরা চাই বিনিয়োগ লাভজনক হোক। আমাদের নীতিগুলো সেভাবেই সাজানো।”
- আইনি সুরক্ষার উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “আইনের শাসন এবং স্বচ্ছতা আমাদের অন্যতম শক্তি। আপনার বিনিয়োগ এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ।”
- কৌশলগত ভৌগলিক অবস্থান ও উন্নত সংযোগ: বাণিজ্যের করিডোর
- তিনি মানচিত্রের মাধ্যমে দেখান কীভাবে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারের সংযোগস্থলে অবস্থিত।
- পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর এবং নতুন এয়ারপোর্ট টার্মিনালের মতো মেগা প্রকল্পগুলোকে তিনি “বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক” হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “এই অবকাঠামোগুলো শুধু ইট-পাথরের স্তূপ নয়, এগুলো হলো বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশ্ব অর্থনীতির সাথে যুক্ত করার সুপার হাইওয়ে।” উদাহরণ: তিনি উল্লেখ করেন, পদ্মা সেতুর কারণে কীভাবে মোংলা বন্দরের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দক্ষিণবঙ্গের কৃষি অর্থনীতি নতুন প্রাণ পেয়েছে।
- ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ বাজার: আপনার হাতের মুঠোয় বিশাল ভোক্তা
- প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশ এবং দ্রুত বর্ধনশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর (প্রায় ৩ কোটির বেশি) ক্রয়ক্ষমতার চিত্র তিনি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “বিশ্ব বাজারের পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব বাজারও বিনিয়োগকারীদের জন্য এক বিশাল আকর্ষণ।”
- তরুণ ও উদ্যমী জনশক্তি: স্মার্ট বাংলাদেশের চালিকাশক্তি
- দেশের ৬৫% কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীকে তিনি “ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড নয়, ডেমোগ্রাফিক ডায়নামাইট” বলে অভিহিত করেন। তার মতে, “সঠিক প্রশিক্ষণ পেলে আমাদের এই তরুণরাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে।”
- সরকারের দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচী এবং হাই-টেক পার্কগুলোতে তরুণদের উদ্ভাবনী কার্যক্রমের উদাহরণ তিনি তুলে ধরেন।
- বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZs) ও হাই-টেক পার্ক: সাফল্যের সুনির্দিষ্ট ঠিকানা
- সম্মেলনে তিনি জানান, সরকার পরিকল্পিত ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে বেশ কয়েকটির কার্যক্রম পুরোদমে চলছে এবং সেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। তিনি বলেন, “এই অঞ্চলগুলো হলো বিনিয়োগের জন্য ‘প্লাগ অ্যান্ড প্লে’ মডেল – আপনি শুধু আপনার পরিকল্পনা নিয়ে আসুন, বাকি সব প্রস্তুত।” উদাহরণ: তিনি মিরসরাইয়উজই শিল্প নগর বা গাজীপুরের কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্কের সাফল্যের গল্প তুলে ধরেন, যেখানে বহু আন্তর্জাতিক কোম্পানি তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে।
-
সম্ভাবনাময় খাত:
তৈরি পোশাক (RMG) শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হলেও, সরকার রপ্তানি আয় বহুমুখীকরণের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে। জনাব আশিক চৌধুরী প্রায়শই কিছু সম্ভাবনাময় খাতের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে বিনিয়োগের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে:
- তথ্যপ্রযুক্তি ও আইটিইএস (ITES): ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের অন্যতম ভিত্তি। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডেটা এন্ট্রি, গ্রাফিক্স ডিজাইন, কল সেন্টার, বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (BPO), ফ্রিল্যান্সিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তরুণরা ভালো করছে। সরকার এই খাতের বিকাশে হাই-টেক পার্ক নির্মাণ, প্রণোদনা প্রদান এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। বছরে প্রায় ১.৯ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় হচ্ছে এবং তা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- ফার্মাসিউটিক্যালস: দেশীয় চাহিদার প্রায় ৯৮% পূরণ করে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে ঔষধ রপ্তানি করছে। এই খাতের গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D), অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস (API) পার্ক স্থাপন এবং বায়োটেকনোলজিতে বিনিয়োগের বিশাল সুযোগ রয়েছে।
- কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ: ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে ফল, সবজি, মাছ, মাংস, দুগ্ধজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও ভ্যালু অ্যাডিশনের মাধ্যমে এই খাতকে লাভজনক করা সম্ভব।
- চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য: উন্নত মানের চামড়ার প্রাপ্যতা এবং দক্ষ শ্রমিকের সমন্বয়ে জুতা, ব্যাগ ও অন্যান্য চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধির অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সাভারের আধুনিক চামড়া শিল্প নগরী এই খাতের প্রসারে সহায়ক।
- হালকা প্রকৌশল: বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল পার্টস, ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ, প্লাস্টিক পণ্য, গৃহস্থালী সরঞ্জাম উৎপাদনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। এটি আমদানি বিকল্প শিল্প স্থাপন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
- নবায়নযোগ্য জ্বালানি: সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০% নবায়নযোগ্য উৎস থেকে (মূলত সৌর ও বায়ু) উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্য পূরণে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিপুল বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
- পর্যটন: কক্সবাজারের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেটের চা বাগান এবং বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক স্থানকে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই খাতে হোটেল, রিসোর্ট, বিনোদন কেন্দ্র এবং সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ প্রয়োজন।
- নীল অর্থনীতি (Blue Economy): বিশাল সমুদ্রসীমা থেকে মৎস্য সম্পদ আহরণ, সামুদ্রিক শৈবাল চাষ, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান এবং সমুদ্র পরিবহন ও পর্যটনে বিনিয়োগের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
- ভৌগলিক অবস্থান:
- আঞ্চলিক যোগাযোগের কেন্দ্র: বাংলাদেশ ভৌগলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এটি ভারত, নেপাল, ভুটান এবং মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি আসিয়ান অঞ্চলের বিশাল বাজারের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করার অপার সম্ভাবনা রাখে।
- ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন:
- পদ্মা বহুমুখী সেতু: দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে রাজধানী ও চট্টগ্রামের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করে অর্থনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে।
- মেট্রোরেল (ঢাকা): রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসন ও গণপরিবহন ব্যবস্থায় আধুনিকতার ছোঁয়া এনেছে।
- কর্ণফুলী টানেল: কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত এই টানেল চট্টগ্রাম অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
- সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন: চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বহুলাংশে বৃদ্ধি করবে। বিশেষ করে, মাতারবাড়ী বন্দরটি একটি আঞ্চলিক বাণিজ্যিক হাব (Regional Transshipment Hub) হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
- বিমানবন্দর আধুনিকায়ন: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ সম্পন্ন হলে এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের মানোন্নয়ন ঘটলে আকাশপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন আরও সহজ ও দ্রুত হবে।
- তরুণ ও দক্ষ জনশক্তি:
- জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাস (Demographic Dividend): বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ (প্রায় ৬৫%) তরুণ ও কর্মক্ষম (১৫-৬৪ বছর বয়সী)। এই বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি বিরাট শক্তি।
- প্রতিযোগিতামূলক শ্রম ব্যয়: তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী শ্রমিকের সহজলভ্যতা এখনও বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণ, যা উৎপাদনমুখী শিল্পের জন্য বিশেষভাবে সুবিধাজনক। তবে সরকার শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
- দক্ষতা উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগ: সরকার চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এবং বাজারের চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে তরুণ প্রজন্মকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং প্রশিক্ষিত করার উপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছে। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (NSDA) সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ লক্ষ্যে কাজ করছে। জনাব চৌধুরী প্রায়ই উল্লেখ করেন, “আমাদের তরুণরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে মানব সম্পদে রূপান্তর করাই আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।”
- বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZs) ও হাই-টেক পার্ক:
- পরিকল্পিত শিল্পায়ন: সরকার দেশব্যাপী ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (সরকারি, বেসরকারি ও জিটুজি ভিত্তিতে) এবং ২৮টিরও বেশি হাই-টেক পার্ক/সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপনের ambisious পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।
- বিশেষ সুবিধা: এই অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্নত অবকাঠামো (যেমন: নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সরবরাহ), ওয়ান স্টপ সার্ভিস, বিশেষ কর প্রণোদনা, সহজ শুল্ক ব্যবস্থা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়, যা বিনিয়োগ প্রক্রিয়াকে সহজ করে এবং পরিচালন ব্যয় হ্রাস করে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (BEZA) এবং বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (BHTPA) এইগুলো ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে।
- ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ বাজার:
- বিশাল ভোক্তা শ্রেণী: প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ একটি বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং মানুষের আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে এই বাজারের আকার ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে।
- শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান: দ্রুত নগরায়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে দেশে একটি উল্লেখযোগ্য মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছে, যাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৫ সাল নাগাদ এই শ্রেণীর আকার ৩ কোটিরও বেশি হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, যা ভোগ্যপণ্য ও সেবার অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে চালিত করছে।
জনাব চৌধুরীর বক্তব্যে প্রতিটি সম্ভাবনার সপক্ষে সুনির্দিষ্ট ডেটা, উদাহরণ এবং সরকারের নীতিগত সহায়তার চিত্র উঠে এসেছে, যা বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে।
বিনিয়োগকারীদের জন্য বার্তা
বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫-এর সমাপনী পর্যায়ে এবং বিভিন্ন সেশনে বিডা চেয়ারম্যান জনাব আশিক চৌধুরীর বার্তা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট, আত্মবিশ্বাসী এবং আহ্বানমূলক:
- কেন এখনই বিনিয়োগ? তিনি বলেন, “অনেকে হয়তো ভাবছেন সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করবেন। আমি বলব, বাংলাদেশের জন্য সেই সঠিক সময়টি হলো এখন। অবকাঠামো প্রস্তুত, নীতি সহায়ক, বাজার উন্মুখ – সাফল্যের সব উপাদানই বিদ্যমান।”
- বিডা: আপনার বিশ্বস্ত নেভিগেটর: তিনি পুনরায় আশ্বস্ত করে বলেন, “বিডা শুধু স্বাগত জানানোর জন্য নয়, আপনার পুরো বিনিয়োগ যাত্রায় পথ দেখানোর জন্য প্রস্তুত। যেকোনো প্রয়োজনে আমরা আছি আপনার পাশে, মাত্র এক ক্লিকে বা এক কলে।”
- সম্মেলন: সম্পর্কের সূচনা: তার মতে, “এই বিনিয়োগ সম্মেলন শেষ হয়েছে, কিন্তু সম্পর্কের শুরু হলো। এখানে যে সংযোগগুলো তৈরি হয়েছে, যে আলোচনাগুলো শুরু হয়েছে, সেগুলোকে আমরা সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চাই।” তিনি বিনিয়োগকারীদের বিডা’র সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
- চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা: তিনি খোলামেলাভাবে কিছু বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করলেও দৃঢ়তার সাথে বলেন, “আমরা চ্যালেঞ্জ লুকিয়ে রাখি না, আমরা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করি। সরকার এবং বিডা একযোগে কাজ করছে একটি শতভাগ বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে।”
তার আহ্বান ছিল – দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বাংলাদেশের অভাবনীয় প্রবৃদ্ধির অংশীদার হোন।
সম্মেলন শেষ, সম্ভাবনার শুরু
বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু এটি একটি সমাপ্তি নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। জনাব আশিক চৌধুরীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিডা যেভাবে দেশের সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে এবং বিনিয়োগকারীদের সার্বিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
সম্মেলন প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশ শুধু কথার ফুলঝুরি নয়, কাজের মাধ্যমে তার সক্ষমতা প্রমাণ করতে প্রস্তুত। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, উদার নীতি, আধুনিক অবকাঠামো, বিশাল বাজার এবং উদ্যমী জনশক্তি – এই পঞ্চশক্তির সমন্বয়ে বাংলাদেশ আজ বিনিয়োগের এক আকর্ষণীয় কেন্দ্র।
আপনি যদি উদ্যোক্তা হিসেবে এই অগ্রযাত্রার অংশ হতে চান, তবে বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫ থেকে প্রাপ্ত বার্তা ও সুযোগগুলো কাজে লাগানোর এখনই সময়। বিডা’র দরজা আপনার জন্য খোলা। আসুন, বাংলাদেশের সমৃদ্ধির পথে একসাথে হাঁটি এবং এক নতুন সাফল্যের গল্প রচনা করি।
আপনি যদি একজন স্বপ্নদর্শী উদ্যোক্তা হন, যিনি একটি বর্ধনশীল বাজারে নিজের ব্যবসার ছাপ রাখতে চান, তবে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাকে কা।জে লাগানোর এখনই সেরা সময়। বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫ এর কার্যক্রমের উপর গভীর দৃষ্টি রাখুন, বিডা’র সাথে যোগাযোগ স্থাপন করুন, এবং বাংলাদেশের অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধির অংশীদার হোন। এখানে বিনিয়োগ শুধু আর্থিক রিটার্নই দেবে না, বরং একটি জাতির রূপান্তরের অংশীদার হওয়ার গৌরবও এনে দেবে।