১৭ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে সম্পদ তৈরির ৮টি অব্যর্থ অভ্যাস

আমরা সবাই আর্থিকভাবে সফল হতে চাই, কিন্তু সফল ব্যক্তিরা ঠিক কী করেন যা তাদের অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে? দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে বিজনেস জার্নালিস্ট হিসেবে আমি দেশের সেরা কর্পোরেট লিডার, সফল উদ্যোক্তা এবং শেয়ার বাজারের কিংবদন্তিদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার মাধ্যমে আমি কেবল তাদের ব্যবসার কৌশলই নয়, বরং তাদের ব্যক্তিগত জীবন এবং অর্থ সম্পর্কিত দর্শনকেও বোঝার চেষ্টা করেছি।

আমি সোনিয়া শেনয়। গত ১৬ বছর টেলিভিশন সাংবাদিকতার পর আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করে এখন আমি একজন স্বাধীন সাংবাদিক। আমার এই দীর্ঘ যাত্রায় আমি যা শিখেছি, তা হলো—সম্পদ তৈরি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, এটি কয়েকটি শক্তিশালী অভ্যাসের ফল। আজ আমি সেই ৮টি অভ্যাস আপনাদের সাথে শেয়ার করব, যা আমি সফল ব্যক্তিদের মধ্যে বারবার লক্ষ্য করেছি।

অভ্যাস ১: অটোমেশন – সাফল্যের চাবিকাঠি

সফল ব্যক্তিরা তাদের ইচ্ছাশক্তির উপর ভরসা করেন না, তারা একটি সিস্টেম তৈরি করেন। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয়তা হলো সেই সিস্টেম।

 প্রতি মাসে মাইনে পাওয়ার পর খরচ করার আগে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার বিনিয়োগ অ্যাকাউন্টে চলে যাবে। একে “Pay Yourself First” নীতি বলা হয়। যখন বিনিয়োগের জন্য আলাদা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় না, তখন ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অনেক সহজ হয়ে যায়।

মনোবিজ্ঞানী রয় বমেইস্টার (Roy Baumeister)-এর গবেষণা অনুযায়ী, আমাদের প্রতিদিনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সীমিত, যাকে “Decision Fatigue” বলা হয়। দিনের শেষে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি এবং সঠিক আর্থিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। অটোমেশন এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়।

বিখ্যাত উক্তি: “আপনি যা অবশিষ্ট থাকে তা সঞ্চয় করবেন না, বরং যা সঞ্চয় করার পর অবশিষ্ট থাকে তা ব্যয় করুন।” – ওয়ারেন বাফেট

 আমি যখন ২০১৪ সালে আমার প্রথম SIP শুরু করি, মতিলাল ওসওয়ালের একটি ফান্ডে মাসে ২০,০০০ টাকা করে, তখন পুরো প্রক্রিয়াটি অটোমেট করে দিয়েছিলাম। মাসের শুরুতে টাকা নিজে থেকেই কেটে নিত। আজ ১০ বছর পর সেই বিনিয়োগের মূল্য ৮০ লক্ষ টাকারও বেশি। যদি আমাকে প্রতি মাসে নিজে থেকে টাকাটা জমা করতে হতো, তাহলে হয়তো কোনো এক মাসে আমি ভুলে যেতাম বা অন্য কোনো খরচের জন্য টাকাটা ব্যবহার করে ফেলতাম।

অভ্যাস ২: আয় নয়, সঞ্চয়ই আসল

আমরা প্রায়ই প্রশ্ন করি, “আপনি কত টাকা আয় করেন?” কিন্তু আসল প্রশ্ন হওয়া উচিত, “আপনি কত টাকা সঞ্চয় করেন?”

 আপনার আয় যতই হোক না কেন, যদি আপনার সঞ্চয়ের হার কম হয়, তাহলে সম্পদ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। একজন ব্যক্তি মাসে ৫০,০০০ টাকা আয় করে ২০,০০০ টাকা সঞ্চয় করলে, তার চেয়ে বেশি সম্পদশালী হতে পারেন যিনি মাসে ১ লক্ষ টাকা আয় করে মাত্র ১০,০০০ টাকা সঞ্চয় করেন।

 টমাস জে. স্ট্যানলি এবং উইলিয়াম ডি. ড্যাঙ্কোর বিখ্যাত বই “The Millionaire Next Door”-এ দেখানো হয়েছে যে আমেরিকার বেশিরভাগ মিলিওনেয়ার বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন না। তারা তাদের আয়ের একটি বড় অংশ সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করেন। তাদের সম্পদ আয়ের উপর নয়, বরং শৃঙ্খলার উপর নির্ভরশীল।

বিখ্যাত উক্তি: “সম্পদ হলো যা আপনি দেখতে পান না। এটা হলো সেই গাড়ি যা কেনা হয়নি, সেই হীরা যা কেনা হয়নি। সম্পদ হলো আর্থিক সম্পদ যা এখনও কোনো কিছুতে রূপান্তরিত হয়নি।” – মর্গান হাউজেল

অভ্যাস ৩: আয়ের চেয়ে কম খরচ করা 

আয় বাড়ার সাথে সাথে জীবনযাত্রার মান বাড়ানো একটি সাধারণ প্রবণতা, যাকে “Lifestyle Creep” বা “Lifestyle Inflation” বলা হয়। কিন্তু যারা সত্যিকারের সম্পদ তৈরি করেন, তারা এই ফাঁদ এড়িয়ে চলেন।

 ধনী ব্যক্তিরা দামের চেয়ে ভ্যালুকে বেশি গুরুত্ব দেন। তারা এমন কিছুতে খরচ করেন যা তাদের জীবনে প্রকৃত মূল্য যোগ করে, লোক দেখানোর জন্য নয়।

 প্রবীণ বিনিয়োগকারী রমেশ দামানি আমাকে একবার বলেছিলেন যে, তার নেট ওয়ার্থ কয়েকশ কোটি টাকা হওয়া সত্ত্বেও তিনি আজও সেই একই গাড়িতে চড়েন এবং একই বাড়িতে থাকেন যা তিনি বহু বছর আগে ব্যবহার করতেন। ওয়ারেন বাফেটের উদাহরণ তো কিংবদন্তিতুল্য। তিনি আজও ১৯৫৮ সালে কেনা সেই একই বাড়িতে বসবাস করেন। তাদের জীবনযাত্রা তাদের আয়ের তুলনায় অনেক সাধারণ।

অভ্যাস ৪: অভাবের মানসিকতা থেকে প্রাচুর্যের মানসিকতায় উত্তরণ

আপনি পৃথিবীকে যেভাবে দেখেন, পৃথিবীও আপনাকে সেভাবেই সাড়া দেয়। আপনার মানসিকতা আপনার আর্থিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।

  • অভাবের মানসিকতা (Scarcity Mindset): “টাকা সীমিত, সুযোগ কম, ঝুঁকি নেওয়া বোকামি।”

  • প্রাচুর্যের মানসিকতা (Abundance Mindset): “সুযোগ অফুরন্ত, ব্যর্থতা হলো শেখার একটি অংশ, এবং ঝুঁকি নিলেই পুরস্কার পাওয়া যায়।”

সফল ব্যক্তিরা সবসময় সুযোগের দিকে তাকান। তারা নিজেদের উপর বিনিয়োগ করেন—নতুন কিছু শেখেন, নতুন ব্যবসায় নামেন এবং ব্যর্থ হতে ভয় পান না।

 স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী ক্যারল ডুয়েক (Carol Dweck)-এর “Growth Mindset” তত্ত্বটি এর সাথে সম্পর্কিত। যাদের গ্রোথ মাইন্ডসেট থাকে, তারা বিশ্বাস করে যে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যেকোনো দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব। এই মানসিকতাই তাদের নতুন সুযোগ গ্রহণ করতে এবং ব্যর্থতা থেকে শিখতে উৎসাহিত করে।

বিখ্যাত উক্তি: “আপনি যা কিছুতে মনোযোগ দেন, তা বৃদ্ধি পায়।” – টনি রবিন্স

অভ্যাস ৫: দীর্ঘমেয়াদী চিন্তাভাবনা (The Power of Compounding)

তাৎক্ষণিক লাভের আশা করা মানুষের স্বভাব, কিন্তু সম্পদ তৈরি একটি ম্যারাথন, স্প্রিন্ট নয়।

চক্রবৃদ্ধি সুদ বা কম্পাউন্ডিংকে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন “বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য” বলেছিলেন। আপনার টাকা যখন সুদ তৈরি করে এবং সেই সুদ আবার নতুন সুদ তৈরি করতে শুরু করে, তখন আপনার সম্পদ জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। কিন্তু এর জন্য সময় দিতে হয়।

ধরা যাক, আপনি ২৫ বছর বয়সে মাসে ১০,০০০ টাকা বিনিয়োগ শুরু করলেন এবং বছরে ১২% রিটার্ন পেলেন। ৬০ বছর বয়সে আপনার তহবিলের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৩.৫ কোটি টাকা। কিন্তু যদি আপনি ১০ বছর দেরি করে ৩৫ বছর বয়সে শুরু করেন, তাহলে ৬০ বছর বয়সে আপনার তহবিলের পরিমাণ হবে মাত্র ১ কোটি টাকা। প্রথম ১০ বছরের বিনিয়োগ আপনার চূড়ান্ত ফলের উপর বিশাল প্রভাব ফেলে।

বিখ্যাত উক্তি: “কেউ আজ ছায়ায় বসে আছে কারণ অনেক দিন আগে কেউ একটি গাছ লাগিয়েছিল।” – ওয়ারেন বাফেট

অভ্যাস ৬: তাড়াতাড়ি শুরু করা (The Golden Decade)

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, আপনি কত টাকা বিনিয়োগ করছেন তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনি কতদিন ধরে বিনিয়োগ করছেন।

২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সকে বিনিয়োগের “সোনালী দশক” বা “Golden Decade” বলা হয়। এই সময়ে আপনার দায়িত্ব কম থাকে, ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা বেশি থাকে এবং কম্পাউন্ডিং-এর জন্য অনেক লম্বা সময় পাওয়া যায়।

 আমার পরিচিত এক ব্যক্তি ২৫ বছর বয়সে একটি ছোট ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম কয়েক বছর খুব কঠিন ছিল, কিন্তু তিনি লেগে ছিলেন। ৩৫ বছর বয়সে তার ব্যবসা একটি স্থিতিশীল জায়গায় পৌঁছায়। অন্যদিকে, তার এক বন্ধু একটি নিরাপদ চাকরি নিয়ে জীবন শুরু করেন এবং ৪০ বছর বয়সে ব্যবসা করার কথা ভাবেন। কিন্তু ততদিনে তার উপর পরিবারের দায়িত্ব, ঋণের বোঝা এবং ঝুঁকি নেওয়ার ভয় চেপে বসেছে। প্রথম ব্যক্তিটি তার সোনালী দশককে কাজে লাগিয়েছিলেন, যা তাকে এগিয়ে দিয়েছে।

অভ্যাস ৭: সিস্টেম ২ থিঙ্কিং (আবেগ নয়, যুক্তি)

আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আবেগ আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। ধনী ব্যক্তিরা আবেগতাড়িত না হয়ে যৌক্তিক এবং বিশ্লেষণাত্মক সিদ্ধান্ত নেন।

 নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কাহনেম্যান তার “Thinking, Fast and Slow” বইতে দুই ধরনের চিন্তার কথা বলেছেন:

  • সিস্টেম ১ (Fast Thinking): এটি দ্রুত, আবেগপ্রবণ এবং সহজাত। যেমন, বাজার পড়তে দেখে আতঙ্কিত হয়ে সব শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া।

  • সিস্টেম ২ (Slow Thinking): এটি ধীর, বিশ্লেষণাত্মক এবং যৌক্তিক। যেমন, বাজার পড়ার কারণ বিশ্লেষণ করা, কোম্পানির ভিত্তি মূল্যায়ন করা এবং এটিকে একটি কেনার সুযোগ হিসেবে দেখা।

ধনী ব্যক্তিরা কঠিন পরিস্থিতিতে সিস্টেম ২ চিন্তাভাবনা ব্যবহার করেন।

বিখ্যাত উক্তি: “একজন বিনিয়োগকারীর প্রধান সমস্যা—এবং এমনকি তার সবচেয়ে বড় শত্রু—সে সম্ভবত নিজেই।” – বেঞ্জামিন গ্রাহাম

অভ্যাস ৮: অর্থের সাথে সুস্থ সম্পর্ক তৈরি করা

ধনী ব্যক্তিরা টাকার পেছনে ছোটেন না, তারা মূল্য (value) তৈরি করার পেছনে ছোটেন। টাকা তার বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে আসে।

 তারা টাকাকে একটি উদ্দেশ্য পূরণের মাধ্যম হিসেবে দেখেন, চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে নয়। রমেশ দামানি যেমনটি বলেছিলেন, “আমরা টাকার মালিক নই, আমরা এর ট্রাস্টি বা তত্ত্বাবধায়ক।” এই মানসিকতা অর্থ সম্পর্কিত লোভ এবং ভয় থেকে মুক্তি দেয়। তারা বোঝেন যে অর্থ স্বাধীনতা দেয়, পছন্দ করার ক্ষমতা দেয়, কিন্তু অর্থই সবকিছু নয়।

 ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি বা উইপ্রোর আজিম প্রেমজি—এরা সবাই এমন একটি উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেছেন যা সমাজের কোনো সমস্যার সমাধান করে। তারা কেবল অর্থ উপার্জনের জন্য কোম্পানি তৈরি করেননি। ফলস্বরূপ, তারা যেমন বিপুল সম্পদ তৈরি করেছেন, তেমনই সমাজের প্রতি নিজেদের দায়িত্বও পালন করেছেন।

এই অভ্যাসগুলো রাতারাতি তৈরি হয় না। এর জন্য প্রয়োজন শৃঙ্খলা, ধৈর্য এবং একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য। সম্পদ তৈরি করা কেবল সংখ্যার খেলা নয়, এটি একটি মানসিকতারও খেলা। আপনি যদি এই অভ্যাসগুলো নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে পারেন, তাহলে আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করা আপনার জন্য কেবল সময়ের অপেক্ষা।

আপনার মতে, কোন অভ্যাসটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? কমেন্টে আমাদের জানান।

Leave a Comment