মাইক্রোসফট বা গুগলের মত একচেটিয়া ব্যবসা করার উপায়

একটি মূল্যবান ব্যবসার বৈশিষ্ট্য কী? বেশিরভাগ মানুষ প্রতিযোগিতাকে ভালো মনে করে, কিন্তু ব্যবসায়ে প্রতিযোগিতা ধ্বংসাত্মক হতে পারে। প্রতিযোগিতা লাভ কমিয়ে দেয় এবং ব্যবসাকে পণ্যের দাম কমানোর দিকে ঠেলে দেয়। থিয়েলের মতে, একটি মূল্যবান ব্যবসা তৈরির জন্য দরকার একটি একচেটিয়া (মনোপলি) অবস্থান, যেখানে কোম্পানিটি এমন কিছু অফার করে যা অন্য কেউ দিতে পারে না। একচেটিয়া ব্যবসার বৈশিষ্ট্য এবং কীভাবে তা তৈরি করা যায় তা বর্ণনা করব।

একচেটিয়া বাজারের প্রভাব

আমরা সাধারণত প্রতিযোগিতাকে ভালো মনে করি। স্কুলে আমাদের শেখানো হয় প্রতিযোগিতা আমাদের উন্নত করে। কিন্তু ব্যবসায়ে, প্রতিযোগিতা কোম্পানিগুলোকে একে অপরের সাথে লড়তে বাধ্য করে, যা লাভ কমায়। উদাহরণস্বরূপ, এয়ারলাইন শিল্পে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে কোম্পানিগুলো কম দামে টিকিট বিক্রি করে, ফলে তারা প্রায়ই লাভ করতে পারে না। ২০১২ সালে আমেরিকান এয়ারলাইনসের লাভ ছিল শূন্যের কাছাকাছি, যেখানে গুগলের লাভ ছিল ২১%। গুগল একটি একচেটিয়া অবস্থানে আছে, কারণ এটি এমন একটি সার্চ ইঞ্জিন সরবরাহ করে যা অন্য কেউ সহজে প্রতিস্থাপন করতে পারে না।

থিয়েল বলেন, সমাজে প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করা হয়, কিন্তু ব্যবসায়ে এটি ধ্বংসাত্মক। একচেটিয়া ব্যবসাগুলো বেশি লাভ করে, নতুন উদ্ভাবনের জন্য বিনিয়োগ করতে পারে এবং কর্মীদের ভালো বেতন দিতে পারে। প্রতিযোগিতা শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও ক্ষতিকর। প্রতিযোগিতায় আটকে থাকা মানুষ অন্যদের সাথে তুলনা করে নিজেদের মূল্য নির্ধারণ করে, যা তাদের স্বাধীন চিন্তা থেকে বঞ্চিত করে।

একচেটিয়া বাজারের বৈশিষ্ট্য

একটি একচেটিয়া ব্যবসার চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো:

১. মালিকানাধীন প্রযুক্তি (Proprietary Technology): একটি কোম্পানির প্রযুক্তি তার প্রতিযোগীদের তুলনায় অন্তত ১০ গুণ ভালো হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, গুগলের সার্চ অ্যালগরিদম অন্যদের তুলনায় অনেক উন্নত, যা এটিকে একচেটিয়া করে। আমাজনের লজিস্টিক সিস্টেমও অন্যদের তুলনায় ১০ গুণ দ্রুত ডেলিভারি দেয়।

২. নেটওয়ার্ক ইফেক্ট (Network Effects): একটি পণ্য যত বেশি মানুষ ব্যবহার করে, তত এটি মূল্যবান হয়। ফেসবুক বা টুইটারের মতো প্ল্যাটফর্মে এটি স্পষ্ট। যদি সবাই ফেসবুক ব্যবহার করে, তবে নতুন ব্যবহারকারীরাও এটি ব্যবহার করতে চাইবে। তবে নেটওয়ার্ক ইফেক্ট শুরুতে ছোট বাজারে কাজ করতে হবে।

৩. স্কেলের অর্থনীতি (Economies of Scale): একটি ব্যবসা যত বড় হয়, তত এর খরচ কমে। সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো এর সেরা উদাহরণ, কারণ তাদের উৎপাদন খরচ প্রায় শূন্য। উদাহরণস্বরূপ, মাইক্রোসফট বা গুগলের মতো কোম্পানিগুলো বিশাল বাজারে সেবা দিতে পারে খুব কম খরচে।

৪. ব্র্যান্ডিং (Branding): শক্তিশালী ব্র্যান্ড একচেটিয়া তৈরি করতে পারে। অ্যাপল এর সেরা উদাহরণ, যেখানে এর ডিজাইন এবং ব্র্যান্ড ইমেজ এটিকে অনন্য করে। তবে ব্র্যান্ডিং কেবল বিজ্ঞাপন নয়; এটি পণ্যের গুণগত মানের উপর নির্ভর করে।

একচেটিয়া বাজার সৃষ্টির উপায়

একটি একচেটিয়া ব্যবসা তৈরির জন্য থিয়েল দুটি কৌশলের পরামর্শ দেন:

১. ছোট বাজার দখল করুন: প্রথমে একটি ছোট, নির্দিষ্ট বাজারে আধিপত্য বিস্তার করুন। উদাহরণস্বরূপ, আমাজন প্রথমে বই বিক্রির বাজারে ফোকাস করে, তারপর ধীরে ধীরে অন্যান্য পণ্যে প্রসারিত হয়। পেপাল প্রথমে ইবে’র পাওয়ার সেলারদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়, তারপর বৃহত্তর বাজারে যায়। ছোট বাজারে সফল হওয়া সহজ, এবং এটি বড় বাজারে যাওয়ার ভিত্তি তৈরি করে।

২. স্কেল আপ করুন: একবার ছোট বাজারে সফল হলে, ধীরে ধীরে বড় বাজারে প্রসারিত হতে হবে। তবে এটি অতিরিক্ত দ্রুত করলে ঝুঁকি থাকে। ফেসবুক প্রথমে হার্ভার্ডের ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তারপর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়, এবং অবশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত হয়।

থিয়েল বলেন, একচেটিয়া তৈরির জন্য শেষ বড় পদক্ষেপ নিতে হবে, যা প্রায়ই প্রথম বড় পদক্ষেপের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। গুগল ১৯৯৮ সালে সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে শুরু করে, কিন্তু ২০০০-এর দশকে বিজ্ঞাপন ব্যবসায় প্রবেশ করে এটি একটি একচেটিয়া হয়ে ওঠে। একটি ব্যবসা তখনই সফল হয় যখন এটি দীর্ঘমেয়াদে তার একচেটিয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারে।

একচেটিয়া বাজার কি ভাল?

সমাজে একচেটিয়াকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়, কারণ এটি প্রতিযোগিতার বিপরীত মনে হয়। কিন্তু থিয়েল বলেন, একচেটিয়া ব্যবসাগুলো সমাজের জন্য ভালো, কারণ তারা নতুন উদ্ভাবনের জন্য বিনিয়োগ করতে পারে। প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসাগুলো লাভের জন্য লড়াই করে, তাই তারা উদ্ভাবনে কম বিনিয়োগ করে। উদাহরণস্বরূপ, গুগলের একচেটিয়া অবস্থান এটিকে এআই, স্বায়ত্তশাসিত গাড়ি এবং অন্যান্য প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে সক্ষম করেছে।

অন্যদিকে, একচেটিয়া ব্যবসাগুলো প্রায়ই নিজেদের একচেটিয়া বলে না। গুগল বলে তারা প্রযুক্তি শিল্পে প্রতিযোগিতা করে, যদিও তারা সার্চ ইঞ্জিন বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে। একইভাবে, প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসাগুলো নিজেদের অনন্য বলে দাবি করে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক রেস্তোরাঁ বলে তাদের খাবার অনন্য, যদিও তারা তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকে। থিয়েল বলেন, এই মিথ্যাগুলো ব্যবসায়িক কৌশলের অংশ, কিন্তু উদ্যোক্তাদের এই মিথ্যা থেকে সাবধান থাকতে হবে।

পেপাল এবং আমাজনের গল্প

তবে থিয়েল পেপাল এবং আমাজনের উদাহরণ ব্যবহার করেন। পেপাল প্রথমে ইবে’র পাওয়ার সেলারদের মধ্যে একচেটিয়া অবস্থান তৈরি করে, যা তাদের বৃহত্তর বাজারে প্রসারিত করতে সাহায্য করে। আমাজন প্রথমে অনলাইন বই বিক্রির বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে, তারপর অন্যান্য পণ্যে প্রসারিত হয়। এই উদাহরণগুলো দেখায় কীভাবে ছোট বাজারে শুরু করে একচেটিয়া তৈরি করা যায়।

একটি মূল্যবান ব্যবসা তৈরির জন্য একচেটিয়া অবস্থান প্রয়োজন। প্রতিযোগিতার ধ্বংসাত্মক প্রকৃতি এবং একচেটিয়ার সুবিধাগুলো তুলে ধরেন। একচেটিয়া তৈরির জন্য মালিকানাধীন প্রযুক্তি, নেটওয়ার্ক ইফেক্ট, স্কেলের অর্থনীতি এবং শক্তিশালী ব্র্যান্ডিং গুরুত্বপূর্ণ। উদ্যোক্তাদের ছোট বাজারে শুরু করে ধীরে ধীরে প্রসারিত করতে হবে এবং একচেটিয়া সম্পর্কে সামাজিক মিথ্যা থেকে সাবধান থাকতে হবে। এই কৌশলগুলো একটি ব্যবসাকে ০ থেকে ১-এ নিয়ে যেতে পারে।

Leave a Comment