হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি। যে এখন এই লেখাটা পড়ছ। হয়তো অফিসের বোরিং মিটিং শেষে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ফোনটা হাতে নিয়েছ। অথবা রোববার রাতের সেই পরিচিত ভয়টা বুকের ভেতর চেপে ধরে ভাবছ, “আর একটা সপ্তাহ!”
কখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করেছ, এই জীবনটাই কি তুমি চেয়েছিলে? মাস শেষে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের স্যালারি, বসের বকাঝকা, সহকর্মীদের সাথে লোক দেখানো হাসি আর অফিসের পলিটিক্স—এই কি তোমার স্বপ্নের শেষ ঠিকানা?
ভেবে দেখো, একটা গড় আয়ু ৭০-৮০ বছর। তার মানে তোমার হাতে আছে মোটামুটি ২৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ দিন। এর মধ্যে কতগুলো দিন তুমি কাটিয়ে ফেলেছ অন্যের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য? কতগুলো সোমবার সকালে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা ছেড়েছ?
তোমার ভেতরের সেই আগুনটা কি নিভে গেছে? নাকি প্রতিদিন একটু একটু করে তুমি নিজেই তাকে নিভিয়ে দিচ্ছ ‘বাস্তবতা’ আর ‘সিকিউরিটি’ নামের জল ঢেলে?
সত্যিটা মেনে নাও
চলো, আজ কোনো ভণিতা না করি। ব্যবসা করার কথা শুনলেই তোমার মাথায় প্রথম যে শব্দগুলো আসে, সেগুলো কী? “ঝুঁকি,” “টাকা নেই,” “অভিজ্ঞতা লাগবে,” “পরিবার কী বলবে?”
এগুলো সব অজুহাত। আবর্জনা।
তোমার আসল সমস্যা টাকা বা অভিজ্ঞতা নয়। তোমার আসল সমস্যা হলো ভয়, মেরুদণ্ডহীন ভয়। চাকরি নামক সোনার খাঁচায় তুমি এত আরামে আছ যে, উড়তে কেমন লাগে সেটাই ভুলে গেছো। খাঁচার মালিক তোমাকে প্রতিদিন খাবার দেয়, তাই তুমি আকাশকে ভয় পেতে শুরু করেছ।
চাকরি তোমাকে নিরাপত্তা দেয় না, কাল যদি তোমার কোম্পানি তোমাকে ছাঁটাই করে, তোমার নিরাপত্তা কোথায় থাকবে? তোমার পুরো জীবনের নিয়ন্ত্রণ অন্য কারো হাতে তুলে দিয়ে তুমি কোন সাহসে নিজেকে নিরাপদ ভাবো?
ব্যবসা মানে অনিশ্চয়তা। হ্যাঁ, একদম সত্যি।
কিন্তু চাকরি মানে নিশ্চিত দাসত্ব। এটাও ততোধিক সত্যি।
এখন তুমি সিদ্ধান্ত নাও, কোনটা বেছে নেবে।
ভাঙা স্বপ্নের গল্প
তুমি যদি একজন পুরুষ হও, তোমার লড়াইটা আরও জটিল। ছোটবেলা থেকে তোমার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, “তোমাকে দায়িত্ব নিতে হবে।” ভালো করে পড়াশোনা করো, একটা ভালো চাকরি জোগাড় করো, তারপর বিয়ে, সংসার, গাড়ি, বাড়ির EMI।
এই ‘ভালো ছেলে’ সাজার দৌড়ে তুমি নিজের ভেতরের ‘পাগল’টাকে গলা টিপে মেরে ফেলেছ। তোমারও ইচ্ছে করে নিজের একটা সাম্রাজ্য গড়তে, নিজের নিয়মে চলতে। কিন্তু “লোকে কী বলবে?” আর “যদি ব্যর্থ হই?”—এই দুটো প্রশ্ন তোমার পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়েছে।
তোমার বন্ধুরা যখন নতুন গাড়ি কিনে ফেসবুকে ছবি দেয়, তোমার ভেতরটা জ্বলে ওঠে। তুমি হাসিমুখে লাইক দাও, কিন্তু ভেতরে ভেতরে জানো, তুমি একটা আপোস করে বেঁচে আছ। তুমি যোদ্ধা হতে চেয়েছিলে, কিন্তু কেরানি হয়ে জীবন পার করে দিচ্ছ। এই আত্মগ্লানি তোমাকে প্রতিদিন একটু একটু করে শেষ করে দেয়। দায়িত্বের নামে তুমি আসলে পালিয়ে বেড়াচ্ছ নিজের স্বপ্ন থেকে।
নারীর অদৃশ্য শিকল
আর তুমি যদি একজন নারী হও, তোমার জন্য খাঁচাটা আরও সুন্দর করে সাজানো। “ব্যবসার মতো কঠিন কাজে মেয়েদের কী দরকার?”, “একটা ভালো চাকরি তো আছেই, আর কী চাই?”, “বিয়ে করে ফেলো, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তোমার চারপাশের সবাই তোমাকে বোঝাতে চায় যে তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা একটা রোগ। তোমার স্বপ্নগুলো যেন সমাজের জন্য বেমানান। ব্যবসা করার কথা বললে তোমাকে শুনতে হয়, “এসব ছেলেদের কাজ।”
তোমার লড়াইটা শুধু আর্থিক স্বাধীনতার নয়, পরিচয়ের লড়াই। তুমি শুধু কারো মেয়ে, কারো স্ত্রী বা কারো মা নও। তোমার একটা নিজস্ব সত্তা আছে, একটা গল্প আছে। যে গল্পটা তুমি নিজের হাতে লিখতে চাও। চাকরি তোমাকে টাকা দেবে, কিন্তু সেই আত্মপরিচয় দেবে না, যা নিজের হাতে গড়া একটা উদ্যোগ দিতে পারে। তোমার ভেতরের শক্তিটাকে ছোট করে দেখো না। যে হাত সংসার সামলাতে পারে, সে হাত একটা ব্যবসাও দাঁড় করাতে পারে।
পরিণতি: দীর্ঘশ্বাস
ভাবো তো একবার, আজ থেকে ২০ বছর পর। তুমি রিটায়ারমেন্টের কাছাকাছি। তোমার ছেলেমেয়েরা নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। তুমি এক সকালে বারান্দায় চায়ের কাপ হাতে বসে আছ। তোমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে হয়তো টাকা আছে, কিন্তু বুকের ভেতরটা ফাঁকা।
তখন তোমার মনে পড়বে সেই আইডিয়াটার কথা, যা নিয়ে তুমি বন্ধুদের সাথে কত রাত জেগে আলোচনা করেছিলে। মনে পড়বে সেই স্বপ্নটার কথা, যা তুমি সাহসের অভাবে শুরুই করতে পারোনি। তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাববে, “ইশ! সেদিন যদি ঝুঁকিটা নিতাম!”
বিশ্বাস করো, ব্যর্থতার কষ্ট সাময়িক। কিন্তু আফসোসের কষ্ট আজীবনের। সেইদিন তোমার কাছে পৃথিবীর সব টাকা থাকলেও, হারিয়ে যাওয়া সময়টা তুমি আর ফেরত পাবে না।
তাহলে উপায় কী?
অনেক তো হলো ভয় আর অজুহাতের গল্প। এবার কাজের কথায় আসি। তুমি যদি সত্যিই এই চক্র থেকে বের হতে চাও, তাহলে নিও না কোনো বিশাল পরিকল্পনা। শুরু করো ছোট পদক্ষেপ দিয়ে।
১. জ্ঞান অর্জন করো, অভিযোগ নয়: সারাদিন ফেসবুক স্ক্রল করে বা বন্ধুদের সাথে আড্ডায় অফিসের বদনাম করে সময় নষ্ট করো না। যে ব্যবসাটা করতে চাও, সেটা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করো। অনলাইনে হাজারো ফ্রি কোর্স আছে, ইউটিউবে সব ধরনের টিউটোরিয়াল পাওয়া যায়। প্রতিদিন এক ঘণ্টা সময় দাও শেখার পেছনে। জ্ঞান তোমার সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
২. ছোট থেকে শুরু করো: ব্যবসা মানেই বিশাল অফিস আর ১০০ জন কর্মচারী নয়। তোমার ঘর থেকেও ব্যবসা শুরু করা যায়। একটা ফেসবুক পেজ খুলে কিছু বিক্রি করার চেষ্টা করো। একটা ছোট সার্ভিস অফার করো। প্রথম গ্রাহক পাওয়া, প্রথম টাকাটা আয় করা—এই অনুভূতিটাই তোমার ভেতরের আগুনকে উস্কে দেবে। চাকরির পাশাপাশি শুরু করো। ঘুম একটু কমাও, আড্ডা একটু ছাড়ো।
৩. সমস্যার সমাধান খোঁজো: মানুষ প্রোডাক্ট কেনে না, মানুষ তাদের সমস্যার সমাধান কেনে। চারপাশে তাকাও। দেখো মানুষের কী প্রয়োজন। কোন জিনিসটা তাদের জীবনকে আরও সহজ করে দিতে পারে। তোমার ব্যবসার আইডিয়া যদি কারো সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে সাফল্য আসবেই।
৪. ব্যক্তিগত ব্র্যান্ড তৈরি করো: মানুষ এখন কোম্পানির চেয়ে ব্যক্তিকে বেশি বিশ্বাস করে। তুমি যা নিয়ে কাজ করতে চাও, সে বিষয়ে লেখালেখি শুরু করো। নিজের জ্ঞান শেয়ার করো। মানুষ যখন তোমাকে একজন এক্সপার্ট হিসেবে চিনবে, তখন তোমার উপর ভরসা করবে। তোমার প্রথম গ্রাহক তোমার পরিচিতরাই হবে।
৫. টাকা ম্যানেজ করতে শেখো: চাকরির বেতন পেয়েই পুরোটা উড়িয়ে দিও না। একটা অংশ আলাদা করে রাখো তোমার ব্যবসার জন্য। অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দাও। কয়েক মাস কফি শপে যাওয়া বা নতুন গ্যাজেট কেনা বন্ধ রাখলে তুমি দেউলিয়া হয়ে যাবে না, কিন্তু তোমার স্বপ্নের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজিটা জমে যাবে।
সিদ্ধান্তটা তোমার
এই লেখাটা পড়ার পর তোমার সামনে দুটো রাস্তা খোলা।
এক, তুমি এই ট্যাবটা বন্ধ করে আবার নিজের সেই গৎবাঁধা জীবনে ফিরে যাবে। সোমবারের জন্য অপেক্ষা করবে আর মনে মনে নিজের ভাগ্যকে দোষ দেবে।
দুই, তুমি আজ রাতেই একটা নোটবুক নিয়ে বসবে। নিজের আইডিয়াটা লিখবে এবং সেটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রথম ছোট পদক্ষেপটা কী হতে পারে, তা ঠিক করবে। হয়তো একটা ডোমেইন কিনবে, বা নিজের ব্যবসার জন্য একটা ফেসবুক পেজ খুলবে।
মনে রেখো, পৃথিবী তাদেরকেই মনে রাখে যারা স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার সাহস দেখায়। ইতিহাস ঘুমন্ত মানুষেরা লেখে না, লেখে পাগলেরা, স্বপ্নবাজেরা।
তোমার গল্পটা কি আফসোসের হবে, নাকি সাহসের?
সিদ্ধান্তটা তোমার। সময় শুরু হলো এখন।